ডিরোজি ও ইয়াং বেঙ্গল মুভমেন্ট

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - ইংরেজ শাসন আমলে বাংলায় প্রতিরোধ, নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন | | NCTB BOOK

হেনরি লুই ডিরোজিও ১৮০৯ সালের ১৮ই এপ্রিল কোলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা ছিলেন পর্তুগিজ এবং মা ছিলেন বাঙালি। ডিরোজিও ইংরেজি শিক্ষার স্কুল ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা একাডেমিতে পড়ালেখা শুরু করেন । স্কুলে প্রধান শিক্ষক ড্রামন্ড ছিলেন প্রগতিবাদী, সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ মানবতাবাদী অত্যন্ত নিষ্ঠাবান শিক্ষক । এই শিক্ষকের আদর্শ ডিরোজিওকে তাঁর শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রভাবিত করে রেখেছিল। যে কারণে পরবর্তীকালে তিনি হতে পেরেছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের যোগ্য উত্তরসূরি । তিনি ছিলেন ‘রেনেসাঁ' যুগে বাঙালি যুব সমাজের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী “ইয়াং বেঙ্গল’ আন্দোলনের প্রবক্তা । বয়সে তরুণ হলেও তিনি ইতিহাস, ইংরেজি, সাহিত্য, দর্শন শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর দূরদৃষ্টি, বাগ্মিতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা তৎকালীন তরুণ সমাজকে ব্যাপক প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল ।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে ছিল রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলনের ধারা। দৃঢ়ভাবে সে ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল হিন্দু কলেজের প্রতিভাবান ছাত্রবৃন্দ, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের মাধ্যমে। যার নেতৃত্বে ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুইস ডিরোজিও। তিনি তাঁর ছাত্র-অনুসারীদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার শিক্ষা দেন । ইয়াং বেঙ্গল আন্দোলনের সদস্যরা এ দেশবাসীকে বারবার এ কথাই বোঝাতে চেয়েছে যে, তারা ব্রিটিশ কর্তৃক শাসিত ও শোষিত হচ্ছে। এ কারণে এই তরুণরা ভারতবাসীর স্বার্থবিরোধী সব কাজের ঘোর বিরোধিতা করেছে । যেমন- প্রেস আইন, মরিশাসে ভারতীয় শ্রমিক রপ্তানি, ভারতবাসীর স্বার্থের প্রতি উদাসীন ১৮৩৩ সালের চার্টার আইন এদের দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে ।

তরুণ সমাজের পুরোনো ধ্যান ধারণা পাল্টে দিতে ডিরোজিও কর্তৃক ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একাডেমি অ্যাসোসিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । একাডেমিতে তরুণদের এই শিক্ষা দেওয়া হয় যে, যুক্তিহীন বিশ্বাস হলো মৃত্যুর সমান । নতুন চিন্তাধারায় প্রভাবিত তরুণরা সনাতনপন্থী হিন্দু এবং গোঁড়াপন্থী খ্রিষ্টানদের ধর্মবিশ্বাসেও আঘাত হানে । ফলে এরা ডিরোজিও এবং তার একাডেমির সদস্যদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয় । ১৮৩০ সালে ডিরোজিওর অনুপ্রেরণায় হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ‘পার্থেনন' নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে । এতে সমাজ, ধর্ম, বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকলে কলেজ কর্তৃপক্ষ এটি বন্ধ করে দেয় । তিনি ১৮৩১ সালে 'হিসপাবাস' নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা এবং ‘ইস্ট ইন্ডিয়া' নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন । ঐ বছরই ডিসেম্বরে মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

মৃত্যুর পরও তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলতে থাকে তাঁর হাতে গড়া অনুসারীরা । ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারী ছাত্ররা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে থাকে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ সিকদার, প্যারিচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি প্রমুখ । মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ছাত্র না হলেও তাঁর আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন । ডিরোজিওর অনুসারীদের আন্দোলন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও প্রভাবিত করেছিল।

Content added By
Promotion